Sat, Nov 25, 2017 10:19 AM
লুনা শিরীন : তোকে লিখছি ৩৯ টাইডল্যান্ড ড্রাইভের এক নির্জন বাড়ি বসে । আমার নিজের বাড়ি থেকে বাস দূরত্বে প্রায় সোয়া তিনঘণ্টা দুর হবে এই বাড়ি। কিন্তু ব্রাম্পটনে আমার অফিস থেকে বাসের দুরত্ব মাত্র ৫০ মিনিট । তোকে প্রথমে এই বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ক্যামন ।
ইনেদ মুলেট, বয়স ৫১ বছর , মুল বাড়ি ত্রিনিদাদ । কানাডায় আছে গত ২৫ বছর ,এই বছরের শুরুর দিকে মার্চ / এপ্রিল নাগাদ ইনেদ এর সাথে আমার পরিচয় হয় গুডলাইফ ফিটনেস সেন্টারে , যেখানে আমি রেগুলার ব্যায়ম করতে যাই । কি করে ইনেদ এর বাসায় উঠলাম,কি করে এমন ভিনদেশী মেয়ে আমার এত কাছের মানুষ ও নির্ভরতার মেয়ে হয়ে উঠছে বা উঠলো সে গল্পে পড়ে আসছি । এই বাড়ির ২য় মানুষ সাগা কিম, এসছে কানাডার কুইবেক প্রভিন্স থেকে । মুলত ফরাসী ভাষার ১৭ বছরের মেয়ে সাগা একজন জ্বলজ্বলে সুন্দরী তরুণী , সারাক্ষণ স্কাঈপে বয়ফেন্ড এর সাথে কথা বলছে,আমার ও ইনেদ এর সাথে কথা বলছে আবার নিজের কাজ ও রান্না করছে মন দিয়ে । এই যে, এইমাত্র সাগা ওর ছোট নোটপ্যড নিয়ে কথা বলতে বলতে উপর থেকে নীচে নামলো, সাগা এসছে ওয়াইএমসি-র একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে । সাগা মনে করে ও ইংলিসে কাচা ,কিন্তু আমি জানি সাগা বেশ ভালোভাবেই ইংলিশ বলতে জানে ।
ঘড়িতে এখন বিকেল ছয়টা,ইফতার হতে আরো তিন ঘণ্টা বাকী। বীথি, জীবনে বিচিত্র রকমের কষ্ট / হাহাকার / না পাওয়া আছে,সবার জীবনেই আছে,কিন্তু প্রাপ্তিও কি ভীষণ ভাবে আছে সেটাও তো আমাদের মন প্রান উজার করে বলা দরকার তাই না ? কি ভীষন প্রাপ্তি আছে আমার এই বিদেশ বিভুই-এ তোকে সেই গল্প বলে বোঝানো যাবে না,এই আনন্দ আর বিশ্বাস শুধুই আমাকে আরো বেশী জীবনমুখী করে তোলে । আমি ও সরদার স্যারের মতো বিশ্বাস করি—মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু জীবনের মৃত্যু নেই –জীবন অমর । যুগে যুগে সেই জীবন হাত থেকে হাতের নিশানা বদলে বেচে থাকে । এই যে গতকাল রাতে “ ক্রাচের কর্নেল” বইটা শেষ করে কেবলই মনে হয়েছে – কি করে পৃথিবী এত মিথ্যার উপরে দাড়িয়ে আছে ? কিন্তু আসলেই কি তাই ? তাহের হয়তো নেই আমাদের মাঝে কিন্তু সৎ আর নির্ভীক তাহের তো বেচে আছে সাহসী হয়ে আমাদের ইতিহাসের পাতায়, জীবনের পাতায় ।
এবার আসি আমার প্রসঙ্গে , কি করে ইনেদ কে পেলাম আমি ? তুই তো জানিস নাইয়া যদি বাসায় না থাকে তাহলে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা জার্নি করে বাড়ি ফেরার কোন মানে হয় না। গতবছর এই সামারে আমি ছিলাম ৭৪ বছর বয়সী মনিকা পারকিন্সনের বাসায় ব্রাম্পটনেই, কিন্তু হায় , মনিকা মারা গেলো গতবছরই অগাস্টের মাঝামাঝি । প্রিয় মনিকাও আমার কাছের মানুষ হয়েছিলো । বীথি,এইসব দেশে আমি যতবেশী বিদেশীদের দেখি তত অবাক হই, ভাবি, আহহ বাংলাদেশে এদেরকে টিভিতে দেখে মনে করতাম এরা বুঝি শুধুই ছোট ছোট কাপড় পড়ে যা ইচ্ছে তাই করে । কিন্তু বাস্তবতা যে কত বেশী অন্যরকম সেটাও জানার সুযোগ হোলো এক জীবনেই । মনিকা বা ইনেদ বা আমার অফিসের আরো সব বিদেশী কলিগরা তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে, পরিবারের ব্যাপারে কত বেশী যে মনোযোগী সেটা খুব কাছে থেকে না দেখলে কোনদিন জানা যাবে না । ইনেদ কে বলেছিলাম, আমি সামারের দুইমাস সপ্তাহের কয়েক-টা মাত্র দিন কারো বাসায় থাকতে চাই, তেমন বেশী পে করতে পারবো না, খুব সামান্যই দেবো, কিন্ত আমি একটা প্লেস খুজছি । হাসিমুখে ইনেদ বলে ,আমার একটা বেসমেন্ট আছে, তুমি দেখতে পারো। আমি তো মহাখুশি,এপ্রিল নাগাদ আমি এসে ইনেদ এর বাসা দেখে গেলাম। কিন্তু বাধ সাধলো অন্য জায়গায় , ইনেদ বলে, না লুনা তুমি আমার গেস্ট, তুমি আমার রুমে থাকব, কিছুতেই নীচের ঘরে না। এই নিয়ে তুল –কালাম , কথা চালাচালি ফোনে, ৫১ বছর বয়স ইনেদের দেখলে মনে হবে ৩৫ বছর এর ইয়াং মেয়ে। এই কথোপকথনের ভিতর দিয়ে ইনেদ কে আমি আরো ভালো করে চিনে গেলাম । কিন্তু অন্য জায়গায় ও কিছু হিসেব আছে তাই না বিথী ? সবার উপরে একজন আছেন, যারও হিসেব আছে পাকাপাকি । জুন মাঝের মাঝামাঝি সময়ে আমি বুঝতে পারলাম, আমার গাড়িটা অন্তত দু-মাস চালানো বন্ধ রাখতে হবে। আর আমার অফিস থেকে যেহেতু ইনেদ এর বাসায় আসতে প্রায় ৫০ মিনিট লাগে, তাহলে নিজের বাসায় ফিরে যাওয়াই ভালো । একথা ইনেদ কে জানাবার জন্য ফোন করতেই ইনেদ বলে – না লুনা, তুমি আসো , আমি তোমাকে তোমার অফিসে নামানো / উঠানো করবো, তোমাকে বাস ধরতে হবে না। ভাবতে পারিস বীথি ? আমার চোখে পানি এসে গেলো ওর কথা শুনে । আমি এখন বসে আছি ওর বাসায়, আমাকে থাকতে দিয়েছে ওর বেডরুমে । কতখনি আন্তরিক ইনেদ হয়েছে এটা বলতে আরো কিছু সময় নেবো । সুদু ভাবছি – এই ভালোবাসার প্রপ্তিকে কোথায় রাখবো আমি ? আজকে আর না বীথী,লম্বা হয়ে গেলো চিঠি,এখান থেকেই আবার লেখা সুরু করবো তোকে,ক্যামন ? ল্যাপ-টপ নিয়ে এসছি, থাকবো বুধবার রাত অব্ধি, দেখি এর ভিতরেই আবার লিখবো তোকে । এখন উঠে যাই, ইনেদ আসার আগেই কিছু কাজ সারি—মনে রাখিস –আবার সুরু করবো এখান থেকেই--- আদর ।
৭/৭/২০১৪
আরো পড়ুন: বীথির কাছে চিঠি- ৩৯